মহাকুম্ভের ইতিহাস
মহাকুম্ভ মেলা হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রাচীন এবং পবিত্র উৎসব, যা ভারতের ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। এর ইতিহাস প্রাচীন ভারতীয় পুরাণ এবং আধ্যাত্মিক কাহিনির সঙ্গে সম্পর্কিত। এই মেলার উৎপত্তি এবং তাৎপর্য বোঝার জন্য আমাদের পৌরাণিক গল্প এবং ঐতিহাসিক ঘটনার দিকে নজর দিতে হবে। মহাকুম্ভ মেলা ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এর আধ্যাত্মিক দিকও সমানভাবে উল্লেখযোগ্য।
মহাকুম্ভ মেলা হিন্দু ধর্মের অন্যতম বৃহৎ এবং পবিত্র উৎসব, যা প্রতি ১২ বছর পরপর ভারতের চারটি শহরে—প্রয়াগরাজ, হারিদ্বার, উজ্জয়িন এবং নাসিকে—আয়োজিত হয়। এই মেলা পৃথিবীর বৃহত্তম জনসমাগমের অন্যতম উদাহরণ, যেখানে কোটি কোটি তীর্থযাত্রী পবিত্র নদীতে স্নান করে পাপ মোচন এবং মোক্ষ লাভের আশায় অংশগ্রহণ করেন।
পুরাণের আলোকে মহাকুম্ভের উৎপত্তি
মহাকুম্ভ মেলার মূল ভিত্তি হল সমুদ্র মন্থন। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, দেবতা এবং অসুররা একত্রে সমুদ্র মন্থন করে অমৃত লাভের জন্য। এই প্রক্রিয়ায় সমুদ্র থেকে অনেক মূল্যবান বস্তু উঠে আসে, যার মধ্যে একটি ছিল অমৃতের কুম্ভ (কলস)। সমুদ্র মন্থনের কাহিনি কুম্ভ মেলার উৎপত্তি ব্যাখ্যা করে, তাই হিন্দু ধর্মে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সমুদ্র মন্থনের পর, অমৃতের অধিকার নিয়ে দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। দেবতারা অমৃতের কুম্ভ রক্ষার জন্য দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্র জয়ন্ত-কে দায়িত্ব দেন। জয়ন্ত কুম্ভ নিয়ে ১২ বছর ধরে চারটি স্থানে আশ্রয় নেন—প্রয়াগরাজ, হারিদ্বার, উজ্জয়িন, এবং নাসিক। এই চারটি স্থানে কুম্ভ থেকে অমৃতের ফোঁটা পড়ে।
এই ঘটনাকে স্মরণ করেই এই চারটি স্থানে মহাকুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, এই স্থানগুলোতে স্নান করলে পাপ মোচন হয় এবং আত্মা পবিত্র হয়।
মহাকুম্ভের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মহাকুম্ভ মেলার ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র এবং ধর্মগ্রন্থে কুম্ভ মেলার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন:
- বেদ: বেদে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের উল্লেখ রয়েছে, যেখানে নদীর পবিত্রতায় বিশ্বাস স্থাপন করা হয়েছে।
- মহাভারত: মহাভারতে প্রয়াগরাজের সঙ্গমস্থলে স্নানের মাধ্যমে পাপ মোচনের কথা উল্লেখ রয়েছে।
- পৌরাণিক সাহিত্য: পদ্ম পুরাণ, স্কন্দ পুরাণ, এবং অগ্নি পুরাণে কুম্ভ মেলার তাৎপর্য বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে।
মোগল এবং ব্রিটিশ আমলে কুম্ভ মেলা
- মোগল আমল: মোগল সম্রাট আকবরের আমলে কুম্ভ মেলার গুরুত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। আকবর প্রয়াগরাজের সঙ্গমস্থলের প্রতি গভীর আগ্রহ দেখিয়েছিলেন এবং এটি “অল্লাহাবাদ” নামে পরিচিতি লাভ করে।
- ব্রিটিশ আমল: ব্রিটিশ শাসনের সময় এই মেলার সংগঠনে আরও কাঠামোগত উন্নয়ন ঘটে। বিশাল জনসমাগমের কারণে ব্রিটিশ প্রশাসন এই মেলার গুরুত্ব বুঝতে পেরে এর জন্য নিরাপত্তা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা নেয়।
আধুনিক যুগে মহাকুম্ভ মেলা
বর্তমানে মহাকুম্ভ মেলা বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ হিসেবে পরিচিত। প্রতি ১২ বছর পরপর চারটি স্থানে এটি পালিত হয়। আধুনিক প্রযুক্তি, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তার সাহায্যে মেলা এখন আরও সংগঠিত এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়।
মহাকুম্ভ মেলার পৌরাণিক উৎস
মহাকুম্ভ মেলার উৎপত্তি একটি প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে জড়িত। পুরাণ অনুসারে, দেবতা ও অসুররা সমুদ্র মন্থন করে অমৃতের কুম্ভ (কলস) লাভ করেন। এই অমৃতের জন্য দেবতা ও অসুরদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, এবং সেই সময়ে কুম্ভ থেকে অমৃতের কিছু ফোঁটা প্রয়াগরাজ, হারিদ্বার, উজ্জয়িন এবং নাসিক শহরে পড়ে। এই ঘটনাকে স্মরণ করে প্রতি ১২ বছরে একবার এই চারটি স্থানে কুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। প্রাচীন পুরাণে মহাকুম্ভ মেলার উল্লেখ রয়েছে, যদিও এর সাংগঠনিক রূপ পরে বিকশিত হয়।
প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলা ২০২৫
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ভারতের উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভ মেলা শুরু হয়েছে। এই মেলা ১৩ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। প্রয়াগরাজে গঙ্গা, যমুনা এবং পৌরাণিক সরস্বতী নদীর সঙ্গমস্থলে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়, যা সঙ্গম নামে পরিচিত। হিন্দুদের বিশ্বাস, এই স্থানে স্নান করলে পাপ মোচন হয় এবং আত্মা বিশুদ্ধ হয়।
মেলার বিশেষ দিনসমূহ
মহাকুম্ভ মেলায় স্নানের জন্য কয়েকটি বিশেষ শুভ দিন নির্ধারিত থাকে। ২০২৫ সালের মেলায় ছয়টি শুভ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে:
- ১৩ জানুয়ারি: পৌষ পূর্ণিমা
- ১৪ জানুয়ারি: মকর সংক্রান্তি
- ২৯ জানুয়ারি: মৌনী অমাবস্যা
- ৩ ফেব্রুয়ারি: বসন্ত পঞ্চমী
- ১২ ফেব্রুয়ারি: মাঘী পূর্ণিমা
- ২৬ ফেব্রুয়ারি: মহা শিবরাত্রি
এই দিনগুলোর মধ্যে ১৪ ও ২৯ জানুয়ারি এবং ৩ ফেব্রুয়ারি শাহি স্নানের (রাজস্নান) দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে নাগা সন্ন্যাসীরা স্নান করেন। বিশেষ করে ২৯ জানুয়ারি সবচেয়ে বড় সমাবেশ প্রত্যাশিত, যেখানে প্রায় ৫ থেকে ৬ কোটি তীর্থযাত্রী স্নান করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মেলার আয়োজন ও প্রস্তুতি
মহাকুম্ভ মেলার জন্য প্রয়াগরাজ শহর একদম প্রস্তুত। প্রায় ২০০টা রাস্তা চওড়া করা হয়ে গেছে আর সঙ্গমের দিকে যাওয়া সড়কের দুই পাশে নতুন রঙে দেয়ালটা সাজানো হয়েছে। দেয়ালগুলোতে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনির চিত্র তুলে ধরে রঙিন ছবি আর ম্যুরাল আঁকা হয়েছে। এতদিনে তিন লাখেরও বেশি তীর্থযাত্রী, বিদেশি সহ, এখানে এসেছেন।
ইউনেসকোর স্বীকৃতি
মহাকুম্ভ মেলা ইউনেসকো’র ইনট্যানজিবল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি বা মানবতার অমূর্ত ঐতিহ্য। এই মেলা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি ভারতের সংস্কৃতির বড় একটা অংশও বটে। দেশ-বিদেশের অনেক মানুষ এখানে আসে। ইউনেসকো এই মেলাকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় এর গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে।
উপসংহার
মহাকুম্ভ মেলা হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিকতা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতীক। প্রতি ১২ বছরে একবার আয়োজিত এই মেলা তীর্থযাত্রীদের জন্য পাপ মোচন এবং মোক্ষ লাভের সুযোগ প্রদান করে। এটি ভারতীয় সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তবে বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও এই উৎসব সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
FAQ